ভিউ: ৭৮
আধুনিক বিশ্বের নেপথ্যে ছিলেন যারা!

আমাদের এই পৃথিবী কত সুন্দর।আল্লাহ তাআলা প্রতিটি বস্তুকে একেবারে ঢেলে সাজিয়েছেন।

চাই হোক সে দূর্বাঘাস কিংবা ঘাসফড়িং। আর যদি বলা হয় মানুষের কথা তবে তো আর বলে শেষ করা যাবে না যেআল্লাহ মানুষকে কি কি দিয়েছেন। বরং আল্লাহ মানুষকে কি কি দেননি সেটা বলা খুব সহজ হবে।

কখনো এটা ভেবে দেখেছেনমানুষ ভাবে আমি চোখ বন্ধ করব আর সেটা বন্ধ হয়ে যায়। সে চিন্তা করে আমি চোখ খুলবো আর চোখ খুলেও  যায়। মানুষ ভাবে আমি কথা বলব তার মুখ থেকে কথার আওয়াজ বের হয়। আর এটা ভাবুন তো মানুষ নিজের চিন্তা ভাবনা অনুযায়ী কাজও করতে পারে। কি আশ্চর্য বিষয় তাই না?

আচ্ছা ছাড়ুন তো এসব কথা। আপনি কখনো বাজারে প্লাস্টিকের হাত দেখেছেনসেটার দিকে একবার তাকান আর আপনার নিজের হাতটার দিকে একবার তাকান। এবার এটা ভাবুন দুটোর মধ্যে পার্থক্য কিভেবে পেলেন কিছুদুটোর মধ্যে পার্থক্য হলো , প্লাস্টিকের হাতটা কোন কিছু করতে পারে না। আর আল্লাহ আপনাকে যেই হাত দিয়েছেন সেটা দিয়ে আপনি ইচ্ছে মতো কাজ করতে পারেন। ইচ্ছেমতো নাড়াতে পারেন।যেকোন কিছু ধরতে পারেন। সারা জীবনে এই হাত দিয়ে আমরা কতকিই না করে থাকি।

আরো একটা বিষয় ভেবে দেখুনআপনার কেনার জুতাটা হয়তো ছয় মাস পরেই ছিঁড়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ আপনাকে যেই পা দিয়েছেন সেটা দিয়ে আপনি জন্ম নেওয়ার পর থেকে মৃত্যু অবধি হাঁটছেনদৌড়াচ্ছেনলাফালাফি করছেন। সেই পায়ের তলার চামড়া কি  এক বারের জন্যও ছিঁড়েছেএইতো গেল দু একটা নমুনা মাত্র। ওই যে বললামআল্লাহ মানুষকে কি কি দিয়েছেন সেটা না বলেআল্লাহ মানুষকে কি কি দেননি সেটা বলা সহজ হবে। বাকিটা নিজে নিজে ভেবে দেখুন যেআল্লাহ আপনাকে কতকিই না দিয়েছেন। যদি এগুলো থেকে দু-একটা আপনাকে বা পুরো মানবজাতিকে কম দিতেনতবে আপনার বা পুরো মানব জাতির কি অবস্থা হতো?

এবার আমরা মূল কথায় আসি। এই পুরো পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র মানুষই শ্রেষ্ঠ জীব বা আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সম্মানিত হয়েছে। আর তার বিশেষ কারণ হলোমানুষের মেধা। মানুষের চিন্তা-ভাবনা করার শক্তি আর তা কাজে ফলানোর শক্তি। মানুষের  ভালো-মন্দ বাছাই করার শক্তি।

যেমন দেখুনপৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কত কিছু পাল্টে গেছে। কত পুরাতন ভেঙে নতুন তৈরি হয়েছে। আপনি কখনো ভেবে দেখেছেনএতকিছু তৈরিএত পরিবর্তনএত উন্নয়ন আর এত আধুনিকতা কাদের হাত ধরে। অথবা বলতে পারেন কোন সভ্যতার হাত ধরে হয়েছেএই প্রশ্নটা যদি আপনাকে কোন ব্যক্তি করে আমার মনে হয়আপনি হয়তো উত্তরে এটা বলবেন যেএগুলো ইউরোপীয়দের হাত ধরে হয়েছে। বা  এটা বলতে পারেনরাশিয়া আমেরিকার হাত ধরে হয়েছে।

অথবা এটাও বলতে পারেনব্রিটিশদের হাত ধরে হয়েছে বা ইহুদি-খ্রিস্টানদের হাত ধরে হয়েছে। আমিও একসময় এটাই ভাবতাম। যে কেউই এটা ভাববে। কিন্তু একটা সময় নিজ জাতির ইতিহাস সন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এলো এক আশ্চর্যজনক সত্য। আর সেটা হল,পৃথিবীর বুকে এত উন্নয়ন আর এত আধুনিকতা তৈরি হয়েছে মুসলিম সভ্যতার হাত ধরে। এটা শোনার পর কিছুক্ষণ যেন থ্
হয়েছিলাম। আবেগ-আপ্লুত হয়ে চোখের কোনে এসে জমে ছিল দু-ফোটা নোনা জল। মনে হয়েছিল,যেন কালের আবর্তে চাপা পড়ে আছে আমার নিজ জাতির গৌরব গাঁথা এক উজ্জ্বল ইতিহাস।

মধ্যযুগ মুসলিমদের জন্য ছিল স্বর্ণযুগ। তখনও ইউরোপে ছিল অন্ধকারের এক ভয়াবহ অবস্থা। মধ্যযুগের মুসলিম মনীষীরা কাব্যসাহিত্যসাংস্কৃতিকঅর্থনৈতিক,আইন প্রণয়ন ও জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নতুন নতুন উদ্ভাবন ও উন্নয়ন  করেছিলেন। ইসলামের স্বর্ণযুগে মুসলিমরা ঘড়িকলমলেখার কাগজবই বাঁধাই সহ বিভিন্ন বস্তুর উদ্ভাবন করেন। যা আমরা প্রায় প্রতিদিনই ব্যবহার করে থাকি।

এছাড়া কেরোসিনসালফিউরিক অ্যাসিড আরোও বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের আবিষ্কার করেন। আরবরাই সর্বপ্রথম ম্যাগনেটিক নিডল আবিষ্কার করেন। ইসলামী স্বর্ণযুগের হাত ধরেই  আজকে তৈরি হয়েছে আধুনিক ক্যামেরা। ইবনে আল হাইসাম ছিলেন ক্যামেরা উদ্ভাবনী তত্ত্বের জনক। শুধুতাই নয়তৎকালীন সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ও ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিল মুসলিমদের হাত ধরে।

মুসলিমরা সর্বপ্রথম ২৪ ঘন্টা ব্যাপী হাসপাতাল চালু  করেন। মুসলিম বিজ্ঞানী আল-জাহরাবির বিভিন্ন উদ্ভাবনের হাত ধরে আজকের আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান। তার আবিষ্কৃত অস্ত্রপ্রচার  যন্ত্র-পাতির ব্যবহার আজও রয়েছে। তার উদ্ভাবিত এসব যন্ত্রপাতির জন্য আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান আজও তার কাছে ঋণী।

বিখ্যাত গবেষক জর্জ শর্টান আলজাহরাবির রচিত গ্রন্থ  কিতাবুল তাসরিফকে মেডিকেলের বিশ্বকোষ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনিই সোনারূপা বা গরুর হাড্ডি দিয়ে সফলভাবে দাঁত বাধাই করতে পারতেন। তাকেই বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর প্রথম সফল দাঁত প্রতিস্থাপনকারি চিকিৎসক। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আরো একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন ইবনে সিনা। তিনিও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নয়ন করেন। তার এক শতাব্দি পূর্বে জন্ম নেওয়া আল-রাজি ছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক রত্ন।

তাঁর রচিত বহু বই মধ্যযুগে ইউরোপের চিকিৎসা বিজ্ঞান শাখায় পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হতো।
শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানেই মুসলিমদের অবদান এর কথা যদি বলতে যাই তবে আরও বহু আলোচনা সামনে চলে আসবে।

আপনি এই প্রতিবেদনটি যে ডিভাইসের মধ্যে দেখছেন অর্থাৎ মোবাইল বা কম্পিউটার। এরকম আরো অনেক ডিভাইসযেমন কম্পিউটার ল্যাপটপ এ জাতীয় বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরি বা চালানোর জন্য যে গাণিতিক সূত্র ব্যবহার করা হয় তা তো নিশ্চয়ই জানেন। সেটা হল ’অ্যালগরিদম যদি এই অ্যালগরিদম আবিষ্কার না হতো তবে আজকে পৃথিবীতে মোবাইল- কম্পিউটার কোন কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব হতো না।

তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ গণিতবিদরা এই তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে মেশিন তৈরির কাজ করেন। আর এরপরই কম্পিউটার যুগের সূচনা হয়। আর এই অ্যালগরিদম এর উদ্ভাবক এক মুসলিম বিজ্ঞানী। যার নাম মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খোয়ারিজমী। মধ্যযুগে মুসলিমদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই তৈরি হয় আজকের আধুনিক বিজ্ঞান। মুসলিমদের লিখিত গণিত বইগুলি ১৬ শতক পর্যন্ত ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান পাঠ্য পুস্তক হিসেবে পড়ানো হতো।


শুধু এতোটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়জ্যোতির্বিজ্ঞানে দিনপঞ্জীর হিসাবমহাকাশ গবেষণাতারকারাজির অবস্থানগ্রহের আবর্তনকক্ষ পথমানচিত্রাঙ্কনদিক নির্ণয় যন্ত্র আবিষ্কারএসবেও মুসলিমরা বিপুল উন্নয়ন ও সাফল্য অর্জন করেছিলেন। ইউরোপীয়রা একসময় মনে করত পৃথিবী চ্যাপ্টা। কিন্তু পৃথিবী যে গোলাকার সেটাও আবিষ্কার করেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীর মানচিত্রও অংকন করেন একজন মুসলিম বিজ্ঞানী। মুসলিমরা নানা শিল্পকলাতেও পারদর্শী ছিল।  তারা বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা একত্রে মিলিয়ে নানা রকম আলাদা আলাদা নকশা তৈরি করত। যার দিকে ভালভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবেএকই নকশার বিভিন্ন রূপ তৈরি হচ্ছে।

এছাড়া মুসলিমরাই সুশৃংখল মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করেন।  যা অর্থনীতিকে সুদৃঢ় রাখে। পাতন প্রক্রিয়া বা পরিশোধনগার মুসলিমরাই প্রথম তৈরি করেন। সর্বপ্রথম পানির পাম্প আবিষ্কার করেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা। তাদের মধ্যে  একজন হলেন আল-জাজারী আর অন্যজন হলেন তাকি আল-দীন।

সারকথা হলোমুসলিমরা মধ্য যুগে শতশত বিষয়বস্তুর উদ্ভাবন করেন। যার হাত ধরেই ইউরোপে রেনেসাঁ বা শিল্প বিপ্লব শুরু হয়। আর এসব বিষয়বস্তুর আবিষ্কার যদি তারা না করতেনতবে তৈরী হতো না আজকের আধুনিক বিশ্ব। অথবা সহজ হতো না আমাদের জীবন ব্যবস্থা।

একটা কথা না বললেই নয়মানুষের কাল্পনিক হিরোরা থাকে পর্দার সামনে। আর বাস্তব দুনিয়ার হিরোরা থাকে পর্দার আড়ালেমানুষের চক্ষুর অন্তরালে। আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থা তৈরিতে মুসলিমদের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। আপনি নিজেও অনুসন্ধান করুন এবং নিজ জাতির গৌরব গাঁথা ইতিহাস সম্বন্ধে জানুন। হয়তো আপনার সামনে উন্মোচন হবে আরো বহু ইতিহাসের পর্দা।
                                                                                                                                 
                                                                                                                                      

-ইসরাত জাহান

প্রধান শিক্ষক, তালিমুল কুরআন ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি
সহকারী প্রধান, উম্মুল কুরা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট মাদরাসা